একাধারে একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন মোশাররফ হোসেন। ফেনী-৩ (সোনাগাজী-দাগনভূঁঞা) আসন থেকে বারবার নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য দল মত সকলের অতান্ত প্রিয় একজন জনপ্রতিনিধির উজ্জল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে নির্বাচিত হলেও অন্যদলের নেতাকর্মীদের পর বা শত্রু ভাবেননি কখনো। কোনোদিন তিনি প্রতিপক্ষের কাউকে অপদস্থ বা প্রতিশোধ নিয়েছেন এমন নজির নেই। আজকের দিনে যা বিরলই নয় কল্পনাও করা যায়না।
ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম ১৯৪০ সালের ২২ জানুয়ারি। জন্ম ফেনী শহরে হলেও পৈত্রিক বাড়ী সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের আহম্মদপুর গ্রামে। এক সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধেহ সাধারন মানুষের আস্থার প্রতিক ফেনীর কৃতি সন্তান বাবা এ্যাডভোকেট মরহুম বেলায়েত হোসেনের বড় ছেলে তিনি। তার বাবা স্থানীয় আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘদিন। মোশাররফ হোসেনের ভাইয়েরাও দেশের বাণিজ্যাঙ্গনে বেশ প্রতিষ্ঠিত। হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন ও পরিচালক শাহাদাত হোসেন তার ছোট ভাই। আরেক ছোট ভাই তোফাজ্জল হোসেনও নামকরা ব্যবসায়ী।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক উত্তীর্ন মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেন সপ্তম সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৯৬ সালে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর তার ওপর বর্তায় ফেনী জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব। দীর্ঘদিন তিনি ফেনী জেলা বিএনপির সভাপতি ও দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে হন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। প্রথম বার সপ্তম সংসদে নির্বাচিত হয়ে তিনি জাতীয় সংসদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। দ্বিতীয় বার অষ্টম সংসদের নির্বাচিত হয়ে তিনি জাতীয় সংসদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদে ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।
মোশাররফ হোসেনের বেড়ে ওঠা ব্যবসায়িক অঙ্গনে। মেধা,দক্ষতা, একাগ্রতায় গড়ে তোলেন বে-ইর্স্টান লিমিটেড, তিনি ছিলেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কনফিডেন্স বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান এবং এমজেড এন্টারপ্রাইজের অংশীদারও ছিলেন। ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের একটানা ২২ বৎসর পর্যন্ত উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের শিল্পদ্যোক্তা ও বিজনেস কমিউনিটিতে তার সাফল্য ও বিশেষত্ব নিয়ে কিছু কথা চালু ছিল। বলা হতো, তিনি মাটি ধরলেও সোনা হয়ে যায় । তিনি যাদু জানেন। এ রকম মূল্যায়নের পেছনে যথেষ্ট কারণও ছিল। অচল প্রায় কোনো সেক্টর বা প্রতিষ্ঠানে তিনি সম্পৃক্ত হলে সেটি ঘুরে দাঁড়াতো। সেইসাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উম্মোচন করেছেন নতুন দিগন্ত। যিনি পদ দেখান বা পথ তৈরি করেন তিনি থাকেন সবার আগে। মোশাররফ হোসেনও সেই অগ্রপথিক। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সেগুলোতে এখনো বারবার শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ হয় তার নামটি। বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি রপ্তানির দিগন্ত খুলেছে তার হাতেই। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রার সভাপতি হিসেবে তিনি এ সেক্টরটিকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন উচ্চতায়। অনেকদিন ছিলেন এশিয়ান রিক্রুটমেন্ট কাউন্সিল কনভেনশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতিও। এদেশের লাখ লাখ কর্মী বিশ্বের দেশে দেশে কাজ করছে। বাড়ছে আমাদের রেমিটেন্স। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির শিরায় শিরায় বইছে এর ধারা। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড সোজা রাখার আরেকটি সেক্টর গার্মেন্টস শিল্প। এর পেছনেও বিশাল অবদান মোশাররফ হোসেনের। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন -বিজিএমইএ’র অন্যতম উদ্যোক্তাও তিনি। ছিলেন এর সভাপতিও। সার্ক এশিয়ান বিজনেসম্যান ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন সফলতার সাথে। নির্বাহী সদস্য হিসেবে অবদান রেখেছেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা আবাসিক মিশনে শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা থাকার সময় তার কর্মদক্ষতা ও চিন্তাচেতনায় মুগ্ধ হয়েছেন দেশি-বিদেশি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাকে ১৯৯০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-সিআইপি’র মর্যাদাবান ছিলেন তিনি। তার অবদানের ছোঁয়া পড়েছে বাংলাদেশের ক্রীড়া সেক্টরও। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ছাড়াও হকি ক্লাব এজাক্সের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে বাঙালি অংশীদারিত্বের ব্যবসা করতে পারে না। এই গুণ না-কি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নেই। মোশাররফ হোসেন এই প্রচলিত কথাকে মিথ্যা প্রমান করে দিয়েছেন। বন্ধু জাকিউদ্দিন আহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গঠন করেছেন জাকি মোশাররফ গ্রুপ। বন্ধুর নামটিই রেখেছেন আগে। অনেকে জাকি মোশাররফ বলতে একটি নামই মনে করেন। বাঙালি অংশীদারিত্বের ব্যবসায় কতো সফল তার সেই দৃষ্টান্ত গল্পকেও হার মানায়।
এই মহৎ মানুষটির সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় এবং চেনাজানার সুবাদে আমার মনে হয়েছে এক্ষেত্রে কোনো যাদুকরী বিষয় ছিলো না। অলৌকিক কিছুও ছিলো না। পুরোটাই তার শ্রম-সততা আর একাগ্রতার ফল। শ্রম,সততা, দক্ষতার এমন রসায়ন না থাকাতেই আমাদের হাত দিয়ে যাদুকরী ফল আসে না। মাটিকে সোনায় পরিণত করতে পারি না আমরা। পারলে হয়তো ফেনীতে তথা দেশে আরো মোশাররফ জন্ম নিতেন। একজন মানুষ কতো বিনয়ী, অমায়িক এবং ধৈর্য্যশীল হতে পারেন তা আমি দেখেছি তার মধ্যে। কখনো কারো সাথে কটু কথা বা মুখ কালো করে কথা বলতে দেখেছি বলে মনে হয় না। কেউ তার প্রশংসা করুক তা-ও চাইতেন না। দান করতেন নিঃশব্দে। চাইতেন না কেউ তাকে দানবীর বলুক। ফেনীর সোনাগাজীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন আ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, মোশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, বখতারপুর মুন্সী মোয়াজ্জেম হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, মোশাররফ-মোয়াজ্জেম ইসলামিয়া মাদ্রাসাসহ বেশ ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ আমাদের সমাজে, চারপাশে এমন মানুষও আছেন যার বা যাদের একটি মক্তব বা বাল্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করেও নিজেকে শিক্ষানুরাগী-বিদ্যা উৎসাহীসহ কতো বিশ্লেষণে জাহির করেন। শুনতে খারাপ লাগলেও, কারো বিরাগভাজন হলেও এ সত্য আজ আমাকে বলতেই হচ্ছে।
মোশাররফ হোসেন সম্পৃক্ত ছিলেন সংবাদপত্র জগতের সঙ্গেও। দ্য ডেইলি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস প্রকাশনায় ছিল তার নীরব অবদান। পত্রিকাটির একজন পরিচালকের পাশাপাশি দেশের সাপ্তাহিক-পাক্ষিক বেশ ক’টি পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন অকাতরে। কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি ব্যবসায়িক জার্নাল সম্পাদনাও করেছেন। বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতির সভাপতি হিসেবে এ অঞ্চলকে সারাদেশে তুলে ধরতে ভূমিকা রেখেছেন কোনো হাক-ডাক ছাড়া। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতার পরও চেতনায় তিনি সব সময় ধারন করেছেন ফেনীজেলাকেই। সংসদে এবং জাতীয় রাজনীতিতেও পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘ফেনী’ নামটি জড়িয়ে থেকেছে তার সাথে। রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাকে সম্বোধন করতেন ‘ফেনী মোশাররফ’ নামে। বিএনপি আমলে সংসদে মোশাররফ নামে চার সহকর্মী ছিলেন তারা। তাকে আলাদা করা হতো ‘ফেনী মোশাররফ’ নামে।
সবাইকে কাঁদিয়ে ২০১৪ইং সালের ১৮ আগষ্ট তারিখে না ফেরার দেশে চলে যান জয়যাত্রার এই মহানায়ক।
সবশেষে মোশাররফ হোসেনের সহধর্মীনি ফরিদা হোসেন সম্পর্কে কিছু না বললে লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যায়। এই মহীয়সীর জন্ম চট্টগ্রামের একটি বনেদী ঘরে। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শুধু কথাশিল্পী, কবি, গীতি আলেখ্যকার, নাট্যকার বললে তার পরিচয় শেষ হয় না। কিছুদিন তিনি বেতার-টিভিতে অনুষ্ঠান ঘোষক, সংবাদপাঠকও ছিলেন। তিনিও প্রচারবিমূখ। অত্যন্ত সাদাসিদে নিরহঙ্কারী মানুষ। মহান আল্লাহ তাকে এ শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিক। তিনি ভালো থাকুন। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থভাবে দীর্ঘজীবী করেন।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com
–_–+–++++++++++++++++++++++++++++++
কৈফিয়ত: ১৮ ই আগষ্ট,ফেনী-৩ আসনের সাবেক এমপি মোশাররফ হোসেনের মৃত্যু বার্ষীকি। বহু গুনের অধিকারী ফেনী জেলার অন্যতম কৃতি সন্তান ব্যক্তি মোশারফ হোসেনের প্রতি আমার ব্যক্তিগত ভালো লাগা থেকে তাকে নিয়ে আমার এই লেখা–