রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:৫১ অপরাহ্ন

টাকা দিলেই মিলছে ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য

হাসনাইন ইমতিয়াজ ও আবদুল হামিদ । সমকাল / ১ বার
প্রকাশ: রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

টাকা দিলেই মিলছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং ব্যাংক ব্যালান্সের মতো ব্যক্তির গোপনীয় তথ্য। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম, নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং অ্যাপসের মাধ্যমে এই কার্যক্রম চলছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করলে মিলছে যে কোনো ব্যক্তির গোপন তথ্য। এ জন্য শুধু মোবাইল ফোন নম্বর ও এনআইডি নম্বর দিলেই চলবে।

সমকালের অনুসন্ধানে এমনই একটি অ্যাপসের সন্ধান মিলেছে। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন আরও অ্যাপস ও ওয়েবসাইট শনাক্ত করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। অনুসন্ধানে যে অ্যাপসটির সন্ধান মেলে সেটির নাম ‘সব এখানে’। একই নামে একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই অ্যাপসের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে ব্যাংক ব্যালান্সসহ নাগরিকের ২৫ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করছে দুর্বৃত্তরা। নাগরিকের তথ্য তাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। এই চক্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কর্মীরা জড়িত বলে জানা গেছে।

এই অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট খুললেই কাঙ্ক্ষিত তথ্য মিলছে। অ্যাকাউন্ট খুলতে ই-মেইল ও মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক। অ্যাপসের অ্যাকাউন্টে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা রিচার্জ করতে হয়। তথ্যের ধরনের ওপর চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। সমকাল এক সপ্তাহে একাধিকবার এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের কার্যক্রম অনুসরণ করে। এর মধ্যে দুই ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে এনআইডির তথ্য চাওয়া হয়। ৩০ মিনিটের মধ্যে এনআইডি কার্ডের সার্ভার কপি হাতে পাওয়া গেছে। এর পর দুই ব্যক্তির এনআইডি কার্ডের নম্বর দিয়ে পিডিএফ কপি চাওয়া হয়। সেটাও অল্প সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করেছে তারা।

গত এক সপ্তাহ চক্রের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম যাচাই করে দেখা যায়, টেলিগ্রামে চক্রটির ‘সাপোর্ট সেন্টার’ ও হোয়াসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানে বিলগেটস নামে একটি বাংলাদেশি নম্বর এবং মার্ক জাকারবাগ নামে একটি মার্কিন নম্বর থেকে গ্রুপগুলোতে আপডেট তথ্য সরবরাহ এবং বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সাইবার ইউনিটের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এই চক্রটি যে কোনো নাগরিকের মোবাইল নম্বর দিয়ে এনআইডি কার্ড, এনআইডি কার্ড দিয়ে পুলিশের তথ্য ভান্ডার সিডিএমএস থেকে মামলার তথ্য, কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) ও ব্যাংকে রক্ষিত গ্রাহকের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করছে। এই চক্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জড়িত বলে তাদের কাছে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, এটা ভয়াবহ অভিযোগ। এর ফলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। হাতিয়ে নেওয়া তথ্য অপরাধী চক্র বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে, যাতে নাগরিকের জীবন বিপন্ন হতে পারে।

ভিডিও প্রচারণা
চক্রটি তাদের কাজের প্রচার-প্রচারণার ভিডিও বানিয়ে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিওর বর্ণনায় বলা হচ্ছে– আপনি কি অনলাইনে এমন একটি অ্যাপস খুঁজছেন? যেখানে একটিমাত্র নম্বর দিয়ে প্রতারক ব্যক্তির সব তথ্য বের করতে পারবেন। এ ছাড়া হারানো এনআইডি কার্ড, জন্মসনদ ও টিন সার্টিফিকেট সহজে তৈরি বা পুনরুদ্ধারে ‘সব এখানে’ অ্যাপসে পাচ্ছেন ডিজিটাল সেবা। যে কোনো মোবাইল নম্বর থেকে ব্যক্তির তথ্য, কললিস্ট ও লোকেশনের তথ্য পাবেন। এ ছাড়া এনআইডি দিয়ে যে কারও ফোন নম্বরের কললিস্ট ও এসএমএস নজরদারিসহ মোবাইলের আইএমইআই নম্বর সংগ্রহ করা যাবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের তথ্য, ব্যাংক হিসাবের তথ্য, ফোন নম্বর বা এনআইডি নম্বর দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স উত্তোলন, এনআইডি থেকে ব্যক্তির মামলার সব তথ্যসহ অনেক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ফ্রি সার্ভিসের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং কার নামে খোলা এবং লেনদেনের ফেইক স্ক্রিনশট তৈরি করতে পারবেন। এ ছাড়া এটা ব্যবহার করে রয়েছে আয় করার সুযোগ। এক কথায় ‘সব এখানে’ অ্যাপস হলো আপনার প্রয়োজনীয় সব ডিজিটাল সেবার ‘ওয়ান স্টপ’ সমাধান।

চক্রের সার্ভিস ও চার্জ
সব এখানে অ্যাপসে অটোমেটিক, ম্যানুয়াল, ফ্রি ও অন্য সার্ভিস চালু আছে। এর মধ্যে অটোমেটিক সার্ভিসে এনআইডির সার্ভার কপি, ওয়েব হ্যাকিং, সাইন টু এনআইডি, টিন সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন তৈরি ও কাস্টম এসএমএস ইচ্ছা মতো তৈরি করে নেওয়া যাচ্ছে। এর জন্য চক্রটি ১০ থেকে ২০ টাকা চার্জ কাটছে।

এ ছাড়া ম্যানুয়াল সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে– ৯৫ থেকে ১৫০ টাকায় ফোন নম্বর দিয়ে এনআইডি কার্ড, ১১০ টাকায় এনআইডি কার্ড পিডিএফ কপি, এক হাজার টাকায় তিন মাসের কললিস্টের সঙ্গে লোকেশন, ৭৫০ টাকায় ফোনের আইএমইআই নম্বর দিয়ে মোবাইল নম্বর, ৫৫০ টাকায় এনআইডি নম্বরে নিবন্ধিত সব মোবাইল নম্বরের তালিকা, দুই হাজার ৭০০ টাকায় অন্যের ফোনের এসএমএস জানা, ৫০০ টাকায় মোবাইল নম্বর দিয়ে আইএমইআই নম্বর, এক হাজার ৬৫০ টাকায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের সব তথ্য এবং ৩০০ টাকায় এনআইডি মামলার তথ্য সরবরাহ করছে চক্রটি। তাদের সার্ভিসের মধ্যে আরও রয়েছে– নিজের এনআইডি দিয়ে বাবা ও মায়ের এনআইডি কার্ডের তথ্য; টিআইএনের সব ধরনের তথ্য এবং এক হাজার ৫০ টাকায় এনআইডি থেকে পাসপোর্টের সব তথ্য সরবরাহ।

এক হাজার ৮০০ টাকায় মোবাইল ব্যাংকিংসহ সিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডিবিবিএল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের হিসাব নম্বর থেকে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যও পাওয়া যাবে বলে দাবি চক্রটির। কাজ হোক আর না হোক, আবেদন দাখিল করলেই অ্যাপসের হিসাব নম্বর থেকে কৌশলে টাকা কেটে নেওয়া হয়।

টেলিগ্রাম চ্যানেলে সতর্ক পোস্ট সম্প্রতি সব এখানে টেলিগ্রাম চ্যানেলে একটি  জরুরি ঘোষণা দিয়েছে চক্রটি। পোস্টে তারা জানায়, ‘গত কয়েক দিন মিডিয়া উঠেপড়ে লেগেছে। সক্রিয় হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা লোকজন। তারা বিভিন্ন  মাধ্যমে এনআইডি ও জন্মসনদ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। এতে অপরিচিত মানুষকে

জরুরি 
সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকুন। অপরিচিত সাইট ভিজিট করা থেকে বিরত থাকুন। সবার আগে নিরাপত্তা ও সম্মান। এসবে আমাদের কিছুই হবে
না, আবার অনেক কিছুই হতে পারে। এটা বাংলাদেশ, দু-চার দিন খুব তদন্ত হবে, এর পর সবাই ভুলে
যাবে। আগামী কয়েকদিন যথেষ্ট নিরাপত্তার সঙ্গে কাজ করার অনুরোধ।’

আরও অ্যাপস শনাক্ত
প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সমকালকে জানান, তারা এ ধরনের পাঁচ-ছয়টি অ্যাপস শনাক্ত করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন এসবের সঙ্গে জড়িত না হলে গোপনীয় তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বিষয়গুলো তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। এভাবে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে কাজ করছে সরকার।


এ জাতীয় আরো খবর...