ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। এই নির্বাচন কেবল একটি ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব বাছাই নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভিপি পদে সাদিক কায়েম, জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মহিউদ্দীন খান—এই তিনজনের জয় একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: ছাত্ররাজনীতির চিরাচরিত ধারায় পরিবর্তন আসছে।
এই ফলাফলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন যেমন ছাত্রদল এবং বামপন্থী প্যানেলগুলোর তুলনায় শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাপক সমর্থন। যদিও নির্বাচনের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ফলাফল এখনো ঘোষণা করা হয়নি, হলভিত্তিক যে ফলাফল সামনে এসেছে, তাতে শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমর্থনের চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, ভিপি পদে সাদিক কায়েমের ১৪ হাজার ৪২ ভোট পাওয়া এবং জিএস পদে এস এম ফরহাদের ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পাওয়া প্রমাণ করে যে শিক্ষার্থীরা একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
তবে, জগন্নাথ হলের মতো কিছু ব্যতিক্রমী ফলাফলও চোখে পড়েছে, যেখানে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদ এবং বামপন্থী সমর্থিত মেঘমল্লার বসু এগিয়ে ছিলেন। এটি প্রতিটি হলের নিজস্ব রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি এবং শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের প্রতিফলন।
এই নির্বাচনের ফলাফল ছাত্ররাজনীতির জন্য নতুন কী বার্তা নিয়ে এসেছে?
প্রথমত, এটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে নানা অভিযোগ এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার কারণে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের আস্থা হারাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এমন নেতৃত্ব খুঁজছে, যারা তাদের শিক্ষাগত এবং সামাজিক অধিকারের জন্য কাজ করবে, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দলাদলিতে নিজেদের জড়াবে না।
দ্বিতীয়ত, এই ফলাফল প্রমাণ করে যে ভিন্ন মতাদর্শের ছাত্র সংগঠনগুলোও যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তারা ব্যাপক সমর্থন পেতে পারে। শিবির সমর্থিত প্যানেলের জয় তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর সক্ষমতার প্রমাণ।
তৃতীয়ত, এই নির্বাচন ভবিষ্যতে ছাত্ররাজনীতির পথচলা কেমন হবে, তা নিয়ে একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি হয়তো আদর্শভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিতে নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন প্যানেলের আবির্ভাব ঘটাবে। এই বিজয় হয়তো অন্যান্য নতুন বা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ছাত্র সংগঠনগুলোকে মূলধারার রাজনীতিতে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করবে।
সব মিলিয়ে, ডাকসু নির্বাচনের এই ফলাফল একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এটি কেবল একটি ছাত্র সংসদের নির্বাচন নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার একটি প্রতিচ্ছবি। এই ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে শিক্ষার্থীরা পরিবর্তন চায়, এবং তারা সেই পরিবর্তনের জন্য বিকল্প নেতৃত্বকে বেছে নিতে প্রস্তুত। এখন দেখার বিষয়, এই নতুন নেতৃত্ব কীভাবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করে এবং ছাত্ররাজনীতির এই নতুন ধারা কতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।