নেপালেও জেন-জির বিক্ষোভের মুখে সরকারের পতন ঘটল। এ ঘটনা সারা দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল পরিস্থিতির বেশকিছু মিল থাকলেও অমিলও কম নয়। বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে হটানোর আর কোনো উপায় ছিল না। ক্ষমতার হাতবদল হয়ে পড়েছিল কল্পনাতীত ও অসম্ভব বিষয়। দিনের ভোট রাতে হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিবাদকে আছড়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। কিন্তু নেপালে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মিত সরকার পরিবর্তন ঘটেছিল। ওইসব নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষই ছিল। পরাজিত দলও কারচুপির অভিযোগ করেছিল বলে শোনা যায়নি।
তবে মিলও আছে অনেক জায়গায়। উভয় দেশেই রাজনীতিবিমুখ হিসাবে পরিচিত তরুণরাই সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। চেতনার ব্যবসায়ীদের উভয় দেশেই বিতাড়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যের বিরোধিতাকারীদের স্বাধীনতাবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করে কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বড়ি গেলানোর কাজ চলছিল, সেটা তরুণরা প্রত্যাখ্যান করেছে। নেপালেও রাজতন্ত্র অবসানের পর জনসাধারণ বামপন্থিদের ভোট দিয়ে আসছিল। প্রতিটি নির্বাচনে বামপন্থিরাই জয়ী হয়ে আসছিল। কিন্তু ওই বাম চেতনার অর্থ যদি হয় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অলির বদলে প্রচন্ড এবং প্রচন্ডের বদলে অলির আসা-যাওয়া, সেটা আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না। উভয় দেশেই তরুণরা কোনো একটি চেতনাকে রাজনীতিকরণ এবং এর মাধ্যমে দেশবাসীকে বিভাজিত করার দিন শেষ করে দিয়েছে।
ভালো কিছু হওয়ার জন্য নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু তবু দেশটি এখনো বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি রয়ে গেছে। বেকারত্বের হার প্রায় ১৩ শতাংশ। চাকরি সৃষ্টি কিংবা নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার বদলে প্রবাস-আয়ের ওপর নির্ভরশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে গণতন্ত্র একটি প্রমাণিত ফাঁকা বুলি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। একদিকে জনসাধারণ আরও গরিব হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের রক্তে রাজনীতিবিদরা ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। এটা মেনে নেওয়া আর সম্ভব ছিল না।
সামাজিক মাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধের কারণেই এ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়নি। ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। সামাজিক মাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে সেটি কেবল বিস্ফোরিত হয়েছে। সেটা অন্য কোনো উসিলাতেও হতে পারত। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, ভারতের দাদাগিরি মেনে না নিতে পারা মানে চীনের আধিপত্য বরণ করা নয়। তরুণরা দেশটিকে বৃহৎ প্রতিবেশীদের ক্রীড়াভূমি হিসাবে দেখতে নারাজ। ফলে নেপালের আগুনে যারা আলু পোড়া খেতে চায়, কিংবা দাবানলটি আরেকটু উসকে দিতে চায়, তাদের সতর্ক হওয়ার দরকার আছে। কারণ, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না মিললে তাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।
নেপালের মতো বাংলাদেশেও জেন-জি সংখ্যাগরিষ্ঠ। মধ্যবিত্তের চিরচেনা ছকটি তারা পালটে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে একসময় নেতৃত্ব দিত শহুরে শ্রেণি। কিন্তু এখন মফস্বল, এমনকি গ্রাম থেকে নতুন শ্রেণির সদস্যরা আসছে। তারা অন্যদের পরিচয়ে এগোতে চায় না। তারা স্বকীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়। তারা তাদের সমস্যার সমাধান চায়। কোনো একটি চেতনার বড়ির নেশায় আসক্ত হতে চায় না। তাদের চাওয়া পাওয়া অভিন্ন। ফলে এক হতে বেশি সময় লাগে না।
বাংলাদেশ ও নেপালের ঘটনা প্রমাণ করেছে, ভারতের প্রশ্রয়, শর্তহীন সমর্থন পেয়ে যেমন টেকা যায় না, একইভাবে ভারত-জুজুর ভয় দেখিয়েও ফায়দা হবে না। ভারত এসে আমাদের দেশ দখল করবে, এই ভয় পেয়ে আপনাদের চিরদিন সমর্থন করে যাবে, এমনটা ভাববেন না। ভেবে থাকলে এখনই হেলিকপ্টারে ঝুলে পালানোর ট্রেনিং নিতে থাকুন। মনে রাখতে হবে, নেপালে হেলিকপ্টারের দড়িতে ঝুলে যেসব নেতা পালিয়েছেন, তারা কিন্তু অনির্বাচিত লোক না। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার দোহাই দিয়ে যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন বলে যারা মনে করবেন, তারা ভুলের মধ্যে রয়েছেন।
চেতনা কপচিয়ে কিংবা আমরা সেই আমলে কী করেছি, তার ফিরিস্তি দিয়ে ক্রিম খাওয়ার দিনও শেষ করে দিয়েছে জেন-জি। এর একটি প্রমাণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু নির্বাচন। রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থি বলে জয়কে ঠেকানো যায়নি। বরং তাদের জয়কে আরও সংহত করা হয়েছে। আবার মাত্র এক বছরের কিছু আগে যে তরুণরা বাংলাদেশের নতুন দিনের গান শোনালেন, অসম্ভবকে সম্ভব করলেন, যাদের এক ডাকে লাখ লাখ তরুণ জীবন দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করল না, তাদের প্রতিনিধিরাও যখন চেতনার ব্যবসা করতে গেলেন, ফ্যাসিবাদের পরিত্যক্ত খোলস নিজের গায়ে জড়াতে চাইলেন, তখন তাদেরও হাওয়া করে দেওয়া হলো শোচনীয়ভাবে। জেন-জিদের বার্তা একটাই : ’৭১ নিয়ে যেমন ব্যবসা করা যাবে না, তেমন ’২৪-এর কারবারিদেরও বরদাস্ত করা হবে না। হিজাবকে গালি দেবেন, হিজাবিকে ভোট দিয়ে শোধ নেবে। পাকিস্তানি ট্যাগ লাগাবেন, আপনাকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেবে। তাই বলে পাকিস্তানি ভেবে সুখ নেবেন না। প্রত্যাশা পূরণ না করতে পারলে আপনাদের অবস্থা হবে আরও শোচনীয়। নিজেকে রাজকন্যা, রাজপুত্র ভাববেন, একেবারে ফকিরের কাতারে নামিয়ে আনবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল এই বার্তাই দিয়ে গেছেন : ‘তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,/অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!’
জেন-জিদের নিয়ে অনেক গালাগাল হচ্ছিল বিশ্বজুড়েই। তারা ফার্মের মুরগি, তারা কিছুই বোঝে না, তারা দুর্বল, তারা অপরিপক্ব, তাদের দিয়ে কোনো কাজই হয় না। কিন্তু শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশই এখন টের পাচ্ছে জেন-জি কী জিনিস। তারা কী চায়, এবং কী করতে পারে। তাদের প্রত্যাশা যারা পূরণ করতে পারবে না, তাদের জন্য আছে হেলিকপ্টারের দড়ি। আবারও বলছি, এখনই ট্রেনিং শুরু করে দিন।
আমাদের জাতীয় কবি জাতির এই প্রত্যাশারই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন :
‘মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!’
মোহাম্মদ হাসান শরীফ : সাংবাদিক