পরিবার মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। এখানে আমরা খুঁজে পাই ভালোবাসা, নিরাপত্তা, প্রশান্তি ও মানসিক সমর্থন। কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, অহংকার, স্বার্থপরতা ও ধৈর্যের অভাবে অনেক পরিবারেই দেখা দেয় অশান্তি। ইসলাম আমাদের শেখায়, পরিবার কেবল সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয়—এটি ইবাদতের ক্ষেত্রও বটে। নবী করিম (সা.)-এর জীবন থেকেই আমরা জানতে পারি কীভাবে দয়া, সম্মান ও ধৈর্যের মাধ্যমে পরিবারে প্রশান্তি বজায় রাখা যায়।
কুরআনের আলোকে পারিবারিক শান্তির ভিত্তি
কুরআনের আলোকে পারিবারিক শান্তির আসল মানে কী? পারিবারিক জীবনের শান্তির মূলমন্ত্র হলো ভালোবাসা ও দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখা।আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً
‘আর তাঁর নিদর্শনসমূহের একটি হলো—তিনিই তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।’ (সুরা আর-রূম: আয়াত ২১)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে বলেছেন, পরিবারের সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি হলো মাওয়াদ্দাহ (ভালোবাসা) ও রহমাহ (দয়া)। একটি পরিবার তখনই শান্তিপূর্ণ হয়, যখন সদস্যরা একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও দয়ার আচরণ করে।
হাদিসের আলোকে পারিবারিক শান্তির ভিত্তি
নবী করিম (সা.)-এর পারিবারিক জীবনের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত মধুর ও প্রেরণাদায়ক। তিনি দেখিয়েছেন জীবনের সৌন্দর্য ও আদর্শ পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা। যা পরিবারে আনে শান্তি ও সফলতা। হাদিসের পরিভাষায় যার কিছু তুলে ধরা হলো-
১. কোমলতা ও সম্মান প্রদর্শন
নবীজি (সা.) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। দুনিয়ার মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তার জীবনে কখনো রুঢ়তার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হাদিসে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ، وَلَا امْرَأَةً وَلَا خَادِمًا
‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কোনো নারী বা দাসকে হাত দিয়ে আঘাত করেননি।’ (মুসলিম, হাদীস: ২৩২৮)
শিক্ষা: পারিবারিক সম্পর্কে রাগ বা কঠোরতা নয়, বরং নরম স্বভাব ও ধৈর্য-ই শান্তির চাবিকাঠি।
২. পরিবারের কাজে সহযোগিতা করা
প্রতি ব্যক্তিরই উচিত, পারিবারিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে নবীজি (সা.)-এর অনুকরণে নিজ নিজ পরিবারের কাজে সহযোগিতা করা। যেমনটি করেছেন নবীজি (সা.) নিজেই। হাদিসে এসেছে-
سَأَلْتُ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: مَا كَانَ النَّبِيُّ ﷺ يَصْنَعُ فِي بَيْتِهِ؟ قَالَتْ: كَانَ فِي مِهْنَةِ أَهْلِهِ
‘আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (সা.) ঘরে কী করতেন? তিনি বললেন, তিনি পরিবারের কাজে সাহায্য করতেন।’ (বুখারি ৬০৩৯)
শিক্ষা: ইসলাম শেখায়, সংসার একক দায়িত্ব নয়—এটি পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র। একসাথে কাজ করলে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
৩. ন্যায়পরায়ণতা ও ভালো আচরণ
পারিবারিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও ভালো আচরণ সর্বোত্তম গুণ। এ গুণের অধিকারীদের নবীজি উত্তম বলে এভাবে ঘোষণা দিয়েছেন-
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ، وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে নিজের পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণ করে; আর আমি তোমাদের মধ্যে পরিবারের প্রতি সর্বোত্তম।’ (তিরমিজি ৩৮৯৫)
শিক্ষা: একজন প্রকৃত মুসলমানের উত্তম চরিত্র সবচেয়ে আগে তার পরিবারের কাছে প্রকাশ পায়। যে পরিবারে পারস্পরিক সম্মান ও ন্যায়পরায়ণতা থাকে, সেখানে আল্লাহর বরকত নেমে আসে।
৪. রাগ নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমাশীলতা
রাগ এমন একটি আবেগ, যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ নিজের ও অন্যের ক্ষতি করে ফেলে। ইসলাম আমাদের শেখায়, সত্যিকার শক্তি শারীরিক নয় — আত্মনিয়ন্ত্রণেই আসল শক্তি। এ কারণেই নবীজি (সা.) বলেছেন-
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِندَ الْغَضَبِ
‘শক্তিশালী সে নয় যে কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে; বরং শক্তিশালী সে, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।’ (বুখারি ৬১১৪, মুসলিম ২৬০৯)
নবী করিম (সা.) রাগ হলে তিনটি করণীয় শিখিয়েছেন—
> চুপ থাকা – ‘রাগ হলে নীরব থাক।’ (মুসনাদ আহমদ)
> অবস্থান পরিবর্তন করা – ‘দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়া, বসে থাকলে শুয়ে পড়া।’ (আবু দাউদ ৪৭৮২)
> আস্তাগফিরুল্লাহ বলা ও ওজু করা– কারণ রাগ শয়তানের প্ররোচনা, আর পানি শয়তানকে শান্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
‘যারা রাগ সংযম করে ও মানুষকে ক্ষমা করে দেয়—আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৩৪)
শিক্ষা: রাগ অনেক পরিবার ধ্বংসের কারণ হয়। যে নিজের রাগ দমন করে ও অন্যকে ক্ষমা করে, সে শুধু নিজের মনকেই শান্ত করে না বরং আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করে। নবীজি (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন- ক্ষমা ও ধৈর্য পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ উপায়।
পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ৫টি বাস্তব পরামর্শ
> আলোচনা করুন, অভিযোগ নয়: সমস্যার সমাধান হয় আলাপে, ঝগড়ায় নয়।
> ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন: ছোট ভালো কাজেরও প্রশংসা দিন।
> ইবাদতে একসাথে সময় দিন: নামাজ, দোয়া ও কুরআন পাঠ পরিবারে ঐক্য আনে।
> রাগের সময় নীরব থাকুন: নবী (সা.) বলেছেন, ‘রাগ হলে চুপ থাক।’
> আল্লাহর জন্য ক্ষমা করুন: যে ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
মনে রাখতে হবে
পরিবারের শান্তি অর্জন মানে কেবল কলহহীন থাকা নয়, বরং ভালোবাসা, দয়া, সহযোগিতা ও ত্যাগের মেলবন্ধন গড়ে তোলা। নবী করিম (সা.)-এর জীবন আমাদের শেখায়— পরিবারের কাজে সহযোগিতা করা, নম্র থাকা, রাগ দমন করা এবং ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু হওয়াই প্রকৃত ইসলামী পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য।