‘মসজিদ’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে শান্তি, পবিত্রতা এবং আত্মিক প্রশান্তির সুর। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে মানুষ দুনিয়ার কোলাহল, প্রতিযোগিতা ও অহংকার ভুলে যায়, এবং নিজের অস্তিত্ব স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিবেদন করে।
এখানে মাথা নত হয় অহংকারে নয়, ভালোবাসা ও বিনয়ের শক্তিতে। কিন্তু আজ এই পবিত্র স্থানকে ঘিরে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা আমাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে- মসজিদ কি এখন রাজনীতির অঙ্গনে রূপ নিয়েছে?
ইতিহাসে মসজিদের ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে মসজিদ কখনোই দলীয় রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না। নবী করিম সা. এর মসজিদে আলোচনা হতো সমাজের উন্নয়ন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও মানবকল্যাণ নিয়ে। সেখানে কোনো ধরনের ক্ষমতার দখল বা রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না।
মসজিদে তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হতো সত্য ও ন্যায়ের আহ্বান, কোনো দলের স্লোগান নয়। মসজিদের মিম্বর ছিল জ্ঞানের বাতিঘর, বিভেদের নয়, সেখানে ফুটে উঠত নৈতিকতার আলো, উদ্ভাসিত হতো কল্যাণের বার্তা।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মসজিদের পবিত্রতা
ইমাম আবু হানিফা রহ. তার ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়্যাতে লিখেছেন, ‘যে কাজ মসজিদের মর্যাদা ও শান্তি নষ্ট করে, তা হারাম বা মারাত্মকভাবে অপছন্দনীয়।’
ইমাম নববী রহ. মন্তব্য করেছেন, ‘মসজিদ হলো ইবাদত, জিকির ও জ্ঞানের স্থান যেখানে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা মনকে বিভ্রান্ত করে বা উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট করে।’
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ. লিখেছেন, ‘যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, সেখানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা স্থান পাওয়ার উপযুক্ত নয়।’
কুরআনের দৃষ্টিতে মসজিদের মর্যাদা
কুরআনে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য; সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আহ্বান করো না।’ (সুরা আল-জিন: ১৮)
এই আয়াত কেবল ধর্মীয় নির্দেশ নয়, এটি নৈতিক ও সামাজিক সীমানা। মসজিদে রাজনৈতিক লড়াই, দলীয় প্রচারণা বা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রয়াস প্রবেশ করলে তা শুধু পবিত্রতাকে ক্ষুণ্ণ করে না, বরং সমাজের ঐক্যও ভেঙে দেয়।
মসজিদ ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। এখানে মানুষ শেখে বিনয়, শৃঙ্খলা, ভালোবাসা এবং ন্যায়পরায়ণতা। কিন্তু যখন রাজনৈতিক তর্ক, দলীয় বৈষম্য এবং ক্ষমতার প্রতিযোগিতার ছায়া প্রবেশ করে, তখন মিম্বরের ভাষা হারায় তার মহিমা, সেজদার মাটি হারায় তার শান্তি। যেখানে একসময় আল্লাহর ভয়ে হৃদয় কেঁপে উঠত, সেখানে এখন জেগে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন।
বর্তমান বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
ইসলাম রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত। তবে তার স্থান মসজিদের ভেতর নয়। মসজিদ কখনো দলীয় প্রচারণার মাঠ হতে পারে না, এটি নৈতিকতার পাঠশালা, যেখানে মানুষ নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, দল নয়, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো মসজিদের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার। এই ঘরকে মুক্ত করতে হবে রাজনৈতিক ছায়া থেকে, ফিরিয়ে দিতে হবে তার আত্মিক মর্যাদা। মসজিদের মিনারে শোনা যাক কেবল তাসবিহের ধ্বনি, প্রতিধ্বনিত হোক কুরআনের তেলাওয়াত, না যে কোনো দলের নাম, না কোনো প্রভাবের ছাপ।
মসজিদে উচ্চারিত হোক একটাই আহ্বান, ‘হে মানুষ, এসো আল্লাহর ঘরে, যেখানে সবাই সমান, সবাই শান্তিতে।’
রাজনীতি নয় নীতি ফিরে আসুক মসজিদে। ক্ষমতার নয় বিনয়ের জয় হোক সেজদার মাটিতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর