বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া আবারও অনিশ্চয়তার মুখে। বোয়েসেল-এর অভিবাসন ব্যয় এবং সিআইডির তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। মালয়েশিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারে প্রতিবেশী দেশগুলো ইতোমধ্যে নতুনভাবে কর্মী পাঠানো শুরু করলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী গমন এখনো শুরু হয়নি। ফলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অন্য দেশের শ্রমিকরা স্থান পাচ্ছে অথচ বাংলাদেশি কর্মীরা রয়ে যাচ্ছেন অনিশ্চয়তায়।
সরকারি ও বেসরকারি খরচের বৈষম্য: সরকারি সংস্থা বোয়েসেল-এর মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জন্য সরকার অনুমোদিত খরচ ধরা হয়েছে ৭৮ হাজার ৯০০ টাকা যা একেবারেই অবাস্তব এবং কোন যুক্তিতে সরকারি খরচের চেয়ে বেসরকারি অভিবাসন খরচ অস্বাভাবিক কম নির্ধারণ করা হয়েছে তার কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নাই। অভিবাসন খাত সংশ্লিস্টদের ধারণা এবং অভিযোগ বোয়েসেল ভিসা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৬ এই পাঁচ বছরে বোয়েসেলকে জিটুজি চুক্তিতে একচেটিয়া কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ৫ বছরে বোয়েসেল হতাশাজনকভাবে মাত্র ৭ হাজার কর্মী পাঠাতে সক্ষম হয়। অথচ সেই ৫ বছরে নেপাল, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিক নেয় মালয়েশিয়া। বোয়েসেল-এর কর্মসীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ অন্তত ৫ লক্ষ শ্রমিক পাঠানো থেকে বঞ্চিত হয়। টাকার অংকে সেই বঞ্চিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার যার দায়ভার শুধুমাত্র বোয়েসেল-এর।
সম্প্রতি সিআইডি অতি উৎসাহী হয়ে অভিযোগ করেছে, কিছু বেসরকারি এজেন্সি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অভিবাসন খরচ নিয়েছে এবং এ নিয়ে সিআইডি তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলাও করেছে। অথচ এই টাকার অঙ্কটি বোয়েসলের নির্ধারিত খরচের চেয়েও অনেক কম, যা শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সিআইডি’র উদ্দেশ্য ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
বৈষম্যমূলক নজরদারি
সৌদি আরবসহ অন্য দেশে অভিবাসন ব্যয় প্রায় একই হলেও কেবল মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও মামলাজটের কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থা দায়ী। মালয়েশিয়াতে শ্রমিক প্রেরণকারী ১৪টি সোর্স কান্ট্রির মধ্যে কেবল বাংলাদেশেই রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচার বা অর্থপাচারের মামলা হয়। অন্য কোনো দেশেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক প্রভাব
বোয়েসেল-এর ধীরগতির কর্মপদ্ধতির কারণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর পারদর্শিতা নিয়ে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা শঙ্কিত। মালয়েশিয়া সরকার ঘোষিত শুধুমাত্র বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য “ওয়ান অফ প্রোগ্রাম”-এর আওতায় ৭৮৭৩ জন শ্রমিককে ১ জুলাই ২০২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মাঝে পাঠানোর সুযোগ দিলেও এখনো পর্যন্ত বোয়েসেল একজন কর্মীও পাঠাতে পারেনি। পক্ষান্তরে, একই প্রোগ্রামের আওতায় নেপাল ইতোমধ্যে ২০ হাজার কর্মী পাঠিয়েছে এবং ডিসেম্বরের মাঝে আরো ৩০ হাজার কর্মী প্রক্রিয়াধীন আছে।
সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে ধারণা করা যাচ্ছে, বোয়েসেল কর্তৃক হয়তো ১০ জন কর্মীও পাঠানো সম্ভব নয়। বিপর্যয় এড়াতে জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা দ্রুত প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সিদের দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করছেন। অন্যথায় আরো ৭৮৭৩ জন শ্রমিকের স্বপ্ন ভঙ্গের দায় প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং বোয়েসেল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলামকে নিতে হবে।
এতসব প্রতিবন্ধকতার পর আবার অর্থপাচারের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি মালয়েশিয়ার নিয়োগদাতাদের আস্থা কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থায় শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কেন ব্যর্থ হলো প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক প্রেরণ পুনরায় শুরু করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফর করেন। তবে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে সিআইডি’র চলমান তদন্ত ও মামলার কারণে বিষয়টির অগ্রগতি হয়নি।
প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সির সাফল্য
বোয়েসেল-এর ব্যর্থতা ও ভরাডুবির পর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জিটুজি প্লাস চুক্তির আওতায় ২০১৭-১৮ এবং ২০২২-২৪ মেয়াদে প্রায় ৭ লক্ষ ৫৫ হাজার কর্মী সফলভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এতে বিগত ৫ বছরে রেমিট্যান্স আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।
সংকটে প্রবাসীর রেমিট্যান্স
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভরসা রেমিট্যান্স। শ্রমিক রপ্তানি ব্যাহত হলে সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান জটিলতা দ্রুত সমাধান না করলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে এবং প্রবাসী আয়ের ধারা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে জনশক্তি রপ্তানি খাত মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে।