দেশবাসীর আশা ছিল—এবার দিন বদলাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, কেবল ক্ষমতার বদল ঘটেছে, দিনের নয়। বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বহুস্তরে। খুন, ছিনতাই, মব ভায়োলেন্স আজ রোজকার ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকারিতা হারিয়েছে, নাগরিক নিরাপত্তা যেন ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি বৈষম্যের বিরুদ্ধে উচ্চারিত কণ্ঠগুলোও ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্র আদতে কী, সেটাই আজ অনুধাবন করা কঠিন। আমরা বছরের পর বছর শাসিত হয়েছি নানা স্বৈরশাসনের মাধ্যমে—কখনো প্রকাশ্যে, কখনো ছদ্মবেশে। অভিজ্ঞতার অভাবে গণতন্ত্র আমাদের কাছে যেন একটি অপরিচিত শব্দ।
গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভ বা একচ্ছত্র শাসন নয়। জনগণ যখন শোষিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে, তখন সেই শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যেমনটি ঘটেছে অতীতে। কিন্তু যদি বর্তমান শাসকেরাও পূর্বসূরিদের মতো আচরণ করতে থাকে, তাহলে তারা নিজেদেরই বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থাৎ স্থানীয় শাসন। সংবিধানের ৪৯, ৫৯ ও ৬০ ধারা অনুযায়ী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অধীনে প্রশাসন চলবে—তারা পরিকল্পনা প্রণয়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, কর আদায় ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তদারকি করবে। অথচ আজও তৃণমূলে প্রকৃত ক্ষমতা পৌঁছায়নি। এই বিকেন্দ্রীকরণে কোনো সরকারই আগ্রহ দেখায়নি।
জনগণ একসময় স্বপ্ন দেখেছিল—একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে। উপদেষ্টারা নিরপেক্ষ থাকবেন—শুধু শপথে নয়, আচরণেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই নিরপেক্ষতার ছায়াটুকু পর্যন্ত দেখা যায় না।
রাজধানী অতিকায় হয়ে উঠেছে, গ্রামে কাজ নেই, পানি নেই, আর নেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। দেশের মানুষ জানে, রাষ্ট্র থাকলে রাজনীতিও থাকবে। কিন্তু এই রাজনীতি কীসের ভিত্তিতে চলছে?
কেউ যখন অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে, তখন তারা প্রথমেই বলে—তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তারা শিগগির নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন। কিন্তু বাস্তবে তারা নতুন দল গঠন করে, উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়, লোকদেখানো সংস্কারের নামে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এবং সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করে।
রাজনীতির এই চেহারাটা দেশের সাধারণ মানুষও বোঝে। তারা এটাকে বলে পলিটিকস—এই একটা শব্দেই যেন পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র—সবখানে চলছে এই পলিটিকস, যার মূল চালিকাশক্তি আজ হয়ে উঠেছে নিজের লাভ, নিজের আখের গোছানো।
আজ সরকার বদলেছে, কিন্তু রাজনীতি বদলায়নি। ক্ষমতার পালাবদলে যারা আসে, তারা নিজেদের স্বার্থ দেখে, জাতীয় স্বার্থ নয়। তারা দ্রুত দেশের সম্পদ তুলে দিচ্ছে বিদেশি প্রভুদের হাতে। অথচ জনগণের মুক্তি মানে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, অর্থনৈতিক মালিকানাও বটে।
আমাদের দেশ দরিদ্র নয় সম্পদের অভাবে, বরং দরিদ্র কারণ সেই সম্পদের মালিক জনগণ নয়। দেশের অর্থে শিক্ষিত জনশক্তি, শেষমেশ বিদেশে পাড়ি জমায় বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে—তাদের দক্ষতা দেশের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় না। তার চেয়েও ভয়ংকর, দেশের অর্থ ও সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ঠিক এই অর্থনৈতিক মালিকানার প্রশ্নে। পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের সম্পদের ওপর আমাদের অধিকার মানেনি বলেই আমরা যুদ্ধ করেছি। আজ আবার সেই ইতিহাসই যেন অন্য আকারে ফিরে এসেছে।
সুতরাং, আজকের এই বাস্তবতায় প্রশ্ন একটাই—আমরা কী আসলে দিন বদলেছি, নাকি কেবল মুখ বদলেছি?