রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৭ অপরাহ্ন

যেভাবে রোহিঙ্গাদের আন্দামান সাগরে ফেলছে ভারত

বিবিসি বাংলা / ১৭ বার
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৫

ভারতের নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে মায়ানমারের ৪০ জন নিপীড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল ভারত। এমনই অভিযোগ করেছেন ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী। তাদের অভিযোগ, রাজধানী দিল্লি থেকে আটক করে নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে পরে তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।

শুক্রবার (২৯ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। জাতিসংঘ বলছে, ভারত রোহিঙ্গাদের জীবনকে ‘চরম ঝুঁকির’ মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিবিসি জানায়, গত ৯ মে সর্বশেষ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন নুরুল আমিন। সংক্ষিপ্ত ফোনালাপটি ভয়ংকর সংবাদ বয়ে আনে। তিনি জানতে পারেন, তার ভাই খাইরুলসহ পরিবারের আরও চারজনকে ভারতের সরকার মায়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। যেখান থেকে তারা বহু বছর আগে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।

মায়ানমারে বর্তমানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে কিছু জাতিগত গোষ্ঠী ও প্রতিরোধ বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে আমিনের পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

বিবিসি জানায়, তাদের দিল্লি থেকে সরিয়ে নেওয়ার তিন মাস পর বিবিসি মায়ানমারে ওই রোহিঙ্গাদের খুঁজে পায়। বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছেন বাহটু আর্মি (বিএইচএ)-এর কাছে। বিএইচএ মূলত একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী যারা দক্ষিণ-পশ্চিম মায়ানমারে জান্তার সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছে।

এসব শরণার্থী ও দিল্লিতে থাকা তাদের স্বজনদের দাবি, বিশেষজ্ঞদের তদন্ত ও তথ্য জোগাড় করে বিবিসি ঘটনার ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখেছে।

বিবিসি  দেওয়া  তথ্য অনুযায়ী, এই শরণার্থীদের দিল্লি থেকে বিমানে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে নিয়ে শেষে আন্দামান সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। তবে, ফেলে দেওয়ারা আগে তাদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়েছিল। পরে সাঁতরে তীরে ওঠেন তারা। এখন তারা মিয়ানমারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

জন নামে এক রোহিঙ্গা ফোনে তার ভাইকে জানান, ‘আমাদের হাত বেঁধে, চোখ-মুখ ঢেকে বন্দির মতো জাহাজে তোলা হলো। তারপর সমুদ্রে ফেলে দিলো।’

মায়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক টমাস অ্যান্ড্রুজ বলেন, ‘এসব অভিযোগ প্রমাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার হাতে আছে। তিনি জেনেভায় ভারতের মিশন প্রধানের কাছে এ সংক্রান্ত প্রমাণও জমা দিয়েছেন, কিন্তু কোনো উত্তর পাননি।’

এদিকে, বিবিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বহুবার যোগাযোগ করেছে, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।

ভারতে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। দেশটি তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না; বরং ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৩ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধিত হলেও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে প্রকৃত সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি।

২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ভয়াবহ অভিযানের পর লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।

বিবিসি বলছে, চলতি বছরের ৬ মে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত ৪০ জন রোহিঙ্গাকে স্থানীয় থানায় ডেকে পাঠানো হয়। বলা হয়েছিল, সরকারনির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী তাদের ছবি ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর তাদের শহরের ইন্দরলোক আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমিন জানান, সেই সময় তার ভাই ফোন করে জানায় তাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং আইনজীবীর সাহায্য নিতে ও ইউএনএইচসিআরকে খবর দিতে বলেন। এরপর ৭ মে তাদের হিন্দন বিমানবন্দর থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়। সেখানে পৌঁছে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসগুলোর গায়ে লেখা ছিল “ভারতীয় নৌবাহিনী”।

সৈয়দ নূর বলেন, “বাসে উঠেই আমাদের হাত প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়, আর মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়”। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের নৌবাহিনীর একটি জাহাজে তোলা হয়। বড় যুদ্ধজাহাজটিতে তারা প্রায় ১৪ ঘণ্টা ছিলেন। খাওয়ানো হয়েছিল ভাত, ডাল আর পনির।

কিন্তু এ সময় অনেককে মারধর করা হয়, অপমান করা হয়। সৈয়দ নূর বলছেন, “আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। কয়েকজনকে বারবার চড় মারা হয়, অনেককে মারধর করা হয়।”

ভিডিও কলে ফয়াজ উল্লাহ তার হাতে আঘাতের দাগ দেখান। তিনি জানান, তাকে ঘুষি, চড় মারা হয়েছিল, বাঁশ দিয়ে খোঁচানো হয়েছিল। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—“ভারতে অবৈধভাবে কেন এসেছো?”

৪০ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন খ্রিস্টান রোহিঙ্গা। নূরের দাবি, তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন ইসলাম ছেড়ে খ্রিস্টধর্ম নিয়েছেন, কেন হিন্দু হননি। এমনকি তাদের খতনা হয়েছে কি না সেটিও পরীক্ষা করা হয়।

এমনকি তাদের মধ্যে একজনকে কাশ্মিরের পেহেলগাম হামলায় জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। অথচ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ ঘটনার কোনো সম্পর্কের প্রমাণ নেই।

এরপর ৮ মে সন্ধ্যায় তাদের ছোট ছোট রাবারের নৌকায় তুলে সমুদ্রে নামতে বাধ্য করা হয়। হাতে লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তারা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছেন। কিন্তু আসলে তারা ছিল মিয়ানমারে।

এরপর ৯ মে ভোরে স্থানীয় জেলেরা তাদের খুঁজে পান। জেলেরা তাদের ফোন ব্যবহার করতে দেন, সেখান থেকেই তারা ভারতে থাকা স্বজনদের খবর দেন। এরপর থেকে বাহটু আর্মি ওই রোহিঙ্গাদের খাবার ও আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু ভারতে থাকা পরিবারগুলো তাদের ভাগ্য নিয়ে ভীষণ আতঙ্কে।

জাতিসংঘ বলেছে, ভারত রোহিঙ্গাদের আন্দামান সাগরে ফেলে দিয়ে তাদের জীবনকে “চরম ঝুঁকিতে” ফেলেছে।

এদিতে গত ১৭ মে নুরুল আমিনসহ তার এক আত্মীয় ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন, যেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা হয়, এভাবে নির্বাসনে পাঠানোর কাজ বন্ধ করা হয় এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

তবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি অভিযোগগুলোকে “অবাস্তব কল্পনা” বলে মন্তব্য করেন। মামলার শুনানি স্থগিত হয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত হয়েছে। তখন সিদ্ধান্ত হবে, রোহিঙ্গারা শরণার্থী নাকি অবৈধ অভিবাসী এবং তাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি না।

ভারতের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ আর বাসায় থাকেন না। নুরুল আমিন বলছেন, “আমার মনে শুধু ভয় কাজ করে, ভারত সরকার যে কোনো সময় আমাদেরও ধরে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেবে। এখন আমরা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছি।”

জাতিসংঘ থেকে অ্যান্ড্রুজ বলেন, “রোহিঙ্গারা ভারতে থাকতে চায়নি, তারা এসেছে মিয়ানমারের ভয়ংকর সহিংসতা থেকে পালিয়ে। তারা সত্যিই প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে।”


এ জাতীয় আরো খবর...