কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে এখন অবস্থান করছে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা। প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৮৭ শিশু—বছরে প্রায় ৩২ হাজার নতুন সদস্য। ফলে ক্যাম্পের ভেতরে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সৃষ্টি করছে খাদ্য, আবাসন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংকট।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য বলছে, ৮ হাজার একর বনভূমির ওপর বিস্তৃত ৩৩টি ক্যাম্প এখন পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। নতুন অনুপ্রবেশ থেমে নেই। গত এক বছরে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, আশ্রয়শিবিরের বাইরে বসতিও গড়ে উঠছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করেছে, জরুরি অর্থ না পেলে আগামী ৩০ নভেম্বরের পর রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ায় খাদ্যের চাহিদাও প্রতিদিন বাড়ছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ছাড়া সংকট মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ অপরাধে। বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন লাখো ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ, হেরোইনসহ নানান মাদক দেশে প্রবেশ করছে। শুধু গত এক বছরে কক্সবাজার রিজিয়নে উদ্ধার হয়েছে দুই কোটির বেশি ইয়াবা। এ ছাড়া খুন, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রীতিমতো অস্থির। জেলা পুলিশের হিসাবে চলতি বছরের আট মাসেই ২৫০টি মামলা হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি মাদক সংশ্লিষ্ট।
রোহিঙ্গা সংকটের আরও ভয়াবহ দিক হলো—ভুয়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা। ইতিমধ্যে কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে একাধিক রোহিঙ্গা এনআইডি নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তবে অনেকেই সফল হয়ে নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয়ও জোগাড় করেছে। এতে শুধু আইনশৃঙ্খলাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িয়ে পড়ছে।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজনকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ নয়, বরং টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরাপত্তা। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরতে চাইলে সেটি হবে টেকসই। অন্যথায় ফেরত গেলেও তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবে।
ইউএনএইচসিআরের সহকারী হাই কমিশনার রাউফ মাজু মনে করেন, মিয়ানমারের সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় হয়ে রাখাইনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। কেবল মানবিক সহায়তা নয়, রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়নেও জোর দিতে হবে, যাতে ফেরার পর তারা নিজেদের দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট শুধু মানবিক বোঝাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, অপরাধ, মাদক ব্যবসা ও ভুয়া নাগরিকত্ব—সবকিছু মিলিয়ে সংকট প্রতিদিন আরও জটিল হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন ছাড়া এ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই।