শিরোনামঃ
লাখ টাকা ধার করে স্ত্রী-সন্তানসহ আত্মহননকারী মিনারুলের চল্লিশা করলো পরিবার টাকা দিলেই মিলছে ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য জনতার মঞ্চ নিয়ে ‘বাতিল’ মামলা ফের চালু হচ্ছে: দেড় শতাধিক সাবেক আমলাকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা এশিয়ায় ঘুরছে জেনজির শনি: রিন্টু আনোয়ার কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীনের দাফন কুষ্টিয়ায় গাজায় নিহত আরও ৪৯, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘ আশ্রয়কেন্দ্র ভবন থেকে পড়ে চীনা অভিনেতার মৃত্যু সেই প্রাইভেট কারের ধাক্কায় আহত চার নারীর একজনের মৃত্যু গাজায় বোমা বর্ষন বাড়িয়েছে ইসরায়েল, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ফিলিস্তিনিরা সাবেক সার্জেন্ট মেজরের স্বীকারোক্তি: তার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে এক নারী সেনা আত্মহত্যা করেছিলেন
রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০০ অপরাহ্ন

এক নজরে “লালনকন্যা” ফরিদা পারভীনের বর্ণাঢ্য জীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১৩ বার
প্রকাশ: রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশের লোকসংগীতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ফরিদা পারভীন, যিনি তার অসাধারণ গায়কী এবং লালন ফকিরের গানকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুপরিচিত। শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই বরেণ্য শিল্পী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্বামী ও চার সন্তান রেখে গেছেন।

গ্রামের মেয়ে থেকে “লালন সম্রাজ্ঞী” হয়ে ওঠার ধারা

ফরিদা পারভীন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৪ খ্রি.-এ, নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঁওল গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অদম্য আগ্রহ। গানের তালিম নিয়েছিলেন মাগুরা, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি নজরুলগীতি, আধুনিক গান এবং দেশাত্মবোধক গান গেয়েও সুনাম অর্জন করেন।

ফরিদা পারভীনের জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁকবদল আসে যখন তিনি লালন ফকিরের গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি নিয়মিতভাবে লালনগীতি চর্চা শুরু করেন এবং এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তার গাওয়া ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’, ‘সত্য বল সুপথে চল’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ এবং ‘মিলন হবে কত দিনে’ গানগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। লালনের গানকে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে মিশিয়ে নতুন এক ধারা তৈরি করার জন্য তিনি ব্যাপক প্রশংসা পান।

ফরিদা পারভীনের কণ্ঠের গান-সম্ভার বিস্তৃত:

  • সত্য বল সুপথে চল-এর মতো লালনগীতি যা শ্রোতাদের মধ্যে গভীর সংবেদন সৃষ্টি করেছিল।

  • ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা’ প্রভৃতি নজরুলগীতি ও আধুনিক দেশাত্মবোধক গানেও তার কণ্ঠ চেনা ছিল।

বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক (১৯৮৭) দিয়ে সম্মানিত করেছে, এবং ১৯৯৩-এ ‘আন্ধো প্রেম’ চলচ্চিত্রে গাওয়া ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটি গেয়ে পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

সঙ্গীতের প্রতি তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ২০০৮ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননাগুলোর অন্যতম একুশে পদক-এ ভূষিত হন। তার এই সম্মাননা তার দীর্ঘ কর্মজীবনের স্বীকৃতি বহন করে।

ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরেই কিডনিসম্পর্কিত রোগে ভুগছিলেন। গত কয়েক মাসে শারীরিক অবস্থার অবনতি শুরু হয় এবং ২ সেপ্টেম্বর থেকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস শুরু হয় ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজে।

গত কয়েক দিন হাসপাতালে আইসিইউতে ছিলেন, অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবং শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

ফরিদা পারভীন কেবল একজন গায়িকা ছিলেন না; তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে লালনগীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা ছোঁয়া মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছিল। “লালনকন্যা” এবং “লালন সম্রাজ্ঞী” নামে বহু মানুষ তাঁকে অভিহিত করতেন, কারণ তিনি লালনের গানের মাধ্যমে শুধু সুর নয়, মানুষের চেতনা ও বোধ জাগিয়েছেন।

তার মৃত্যু জাতীয় সংগীত-সংস্কৃতি অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। নতুন প্রজন্মের জন্য তিনি একটি পথচিহ্ন হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফরিদা পারভীন ছিলেন এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় — লোকসংগীতের সাথে আধুনিকতার মেলবন্ধন, গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে অনুভূতি ও ও আধ্যাত্মিকতার মিলন। আজ তিনি শেকড় ফিরে গেলেন, কিন্তু তার গানের সুর, তার কণ্ঠের রং, লালনগীতির ম্লান-ম্লান ভাব সবই আমাদের সঙ্গে থাকবে। তাঁর বিদায়ের মধ্য দিয়ে শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু হলো না — হারিয়ে গেল একটি প্রজন্মের যোগাযোগের এক সেতু, একটি শিল্পের অভিসন্ধি।


এ জাতীয় আরো খবর...