ঘাড় ব্যথার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় কী হতে পারে? ঘাড় ব্যথার আদ্যোপান্ত থাকছে এ প্রতিবেদনে।
ঘাড় ব্যথার কারণ
নানারকমের কারণে ঘাড় ব্যথা হয়ে থাকে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে ঘাড় ব্যথাও বেশি হতে থাকে। তবে অনেকসময় অল্প বয়সেও ঘাড় ব্যথা হয়ে থাকে।
আঘাত পাওয়া- যেকোনো দুর্ঘটনা, খেলাধুলা বা কোনো ধরনের শারীরিক আঘাতের ফলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ আঘাতগুলোর মধ্যে একটি হল হুইপ্ল্যাশ, যা দুর্ঘটনায় ঘটে। এতে মাথা দ্রুত পেছনে এবং সামনের দিকে চলে যায়, যা ঘাড়ের লিগামেন্ট এবং পেশীগুলিকে প্রভাবিত করে। পেশী সংকোচন এবং শক্ত হয়ে পেশীগুলির প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঘাড় শক্ত হয়ে যায় এবং এটিতে ব্যথা শুরু হয়।
পেশীর স্ট্রেন বা মোচ- অনেক সময় সাধারণ কিছু ক্রিয়াকলাপ ঘাড়ের পেশীতে চাপ দেয়। এতে প্রধানত দুর্বল ভঙ্গি, ভুল অবস্থানে ঘুমানো, ব্যায়াম করার সময় হঠাৎ ঝাঁকুনি, এমনকি ডেস্কে বসে একটানা কাজ করার করণেও ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হয়।
ভুল ভঙ্গি- দীর্ঘসময় একই ভঙ্গিতে বসে থাকা, মাথা নিচু করে কাজ করলে ঘাড়ের পেশীতে চাপ সৃষ্টি করে।
রোগ – অনেকেই জানেন না, তবে কিছু নির্দিষ্ট অবস্থা যেমন বাত, ক্যান্সার বা এমনকি মেনিনজাইটিসও ঘাড় ব্যথার কারণ।
মেরুদণ্ডের সমস্যা- স্পন্ডাইলোসিস মেরুদণ্ডের সমস্যা ঘাড় ব্যথার অন্যতম কারণ।
বয়স – প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জয়েন্টগুলো ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এর মধ্যে ঘাড়ের জয়েন্টগুলো রয়েছে। বয়স হলে ঘাড়ের টিস্যু ক্ষয় হয়ে যায়। একে অস্টিওআর্থারাইটিস বা স্পন্ডিলোসিস বলা হয়।
অন্যান্য কারণ- সংক্রমণ, টিউমার, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদিও ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে। মানসিক অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকেও ঘাড়ের ব্যথা হতে পারে।
ঘাড় ব্যথার ঝুঁকিতে যারা
সাধারণত পুরুষ বা নারী ৪০ থেকে ৬০ বছর যাদের সবার ক্ষেত্রেই ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা হতে পারে । তবে নারীদের বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া তরুণ প্রজন্ম- যারা কোনো নিয়ম মানতে চান না, ঠিকমত বালিশ ব্যবহার করে না, শোয়ার ভঙ্গি ঠিক থাকে না, দীর্ঘসময় মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার করতে থাকে বা যারা মানসিক অশান্তিতে থাকেন তাদের ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এছাড়া কারো যদি বাবা, মায়ের ঘাড়ে ব্যথা থেকে থাকে অর্থাৎ জেনেটিক কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ঘাড় ব্যথার লক্ষণ
হঠাৎ করেই একদিনে পুরোপুরি ঘাড় ব্যথা হয় না। এটি ধীরে ধীরে শুরু হয়, বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয় ঘাড় ব্যথার। যেসব লক্ষণ দেখলে বুঝতে পারা যাবে ঘাড় ব্যথা হচ্ছে।
ঘাড়ে হালকা বা তীব্র ব্যথা- ঘাড়ে প্রথমদিকে হালকা ব্যথা অনুভব হবে। ধীরে ধীরে এ ব্যথা তীব্র হতে থাকে। এটি এটি দীর্ঘায়িত না হলেও মাঝে মাঝেই ব্যথা জাগ্রত হয়। তবে পরে এ ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়।
ঘাড়ে জ্বালাপোড়া- মাঝে মাঝে ঘাড়ে এমন ভাব হবে যে, মনে হবে ঘাড়ে জ্বালাপোড়া করছে। ঘাড়ের রগ টান ধরবে। রগ শক্ত হয়ে টান ধরলে তা ঘাড়ে জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দেবে।
হাতে বা বাহুতে ব্যথা- সবসময় যে ঘাড় ব্যথা থেকেই তা তীব্র হবে এমনটা নয়। অনেকসময় হাতের ব্যথা থেকে বা বাহুর ব্যথা থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়। ব্যথার সঙ্গে হাতে, বাহুতে হতে পারে ঝিনঝিন, শিরশির, অবশ ভাব, সুচ ফোটানোর অনুভূতি। সেই সঙ্গে হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে অসুবিধা হয়। এ থেকেও ধীরে ধীরে ঘাড় ব্যথা হয়ে থাকে।
ঘাড় ব্যথার প্রতিকার
দৈনন্দিন রুটিনে সামান্য পরিবর্তন আনলে সাধারণ ঘাড় ব্যথার প্রতিকার করা সম্ভব। এসব কাজ করলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়েও ঘাড় ব্যথা নিরাময় করা সম্ভব। একটানা পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকা- সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটার মতো পরিশ্রমের কাজ অনেক বেশি সময় করলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। সেজন একটানা এ কাজ না করে মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে করতে হবে।
বসে থাকার ভঙ্গি- বসে থাকার সময় মেরুদণ্ড সরলরেখায় রাখতে হবে। মাথা সোজা রাখতে হবে যেন কান কাঁধ বরাবর থাকে। দীর্ঘসময় একটানা বসে কাজ না করে এক ঘণ্টা পরপর ১০ মিনিট বিরতি নিতে হবে। দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বা দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করলে মাঝে মাঝে উঠতে হবে। ঘাড় ও কাঁধ সামনে–পেছনে প্রসারিত করতে হবে।
কাজের টেবিল–চেয়ার ও কম্পিউটার সামঞ্জস্য করতে হবে। যেন মনিটর চোখের স্তরের সমান থাকে। দুই হাঁটু হিপের কিছুটা নিচে থাকবে। চেয়ারে আর্মরেস্ট বা হাতল ব্যবহার করা ভালো। টেবিলে কুঁজো হয়ে বসা যাবে না।
ভারী বস্তু তোলা থেকে বিরত থাকা- কাঁধের ওপর স্ট্র্যাপসহ ভারী ব্যাগ বহন এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত ওজন ঘাড়ে চাপ তৈরি করে ব্যথার সৃষ্টি করে।
ধূমপান থেকে বিরত থাকা- ধূমপায়ী ব্যক্তিরা ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। সেজন্য ঘাড় ব্যথা থেকে মুক্ত থাকতে ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে।
বেশিক্ষণ হাত উঠিয়ে না রাখা- বেশি সময় হাত উপরের দিকে উঠেয়ে রাখা যাবে না। বেশিরভাগ মুঠোফোনে কথা বলার সময় কান ও কাঁধের মধ্যে ফোনটি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে হেডফোন বা ফোনের স্পিকার অন করে নিতে হবে।
ঘুমানোর অভ্যাস পরিবর্তন- মাঝারি-শক্ত সমান বিছানায় এক বালিশে চিত হয়ে ঘুমাতে হবে। ঘুমানোর সময় ঘাড়ের নিচে বালিশ দিতে হবে। দরকার হলে বালিশ টেনে নামিয়ে ঘাড়ের নিচে নিতে হবে বা কম উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করতে হবে। যেন মেরুদণ্ডের পেশি সমতল থাকে।
এসবের মাধ্যমে নিরাময় না হলে বুঝতে হবে ঘাড় ব্যথা তীব্র পর্যায়ে চলে গিয়েছে। তখন চিকিৎসকের সরণাপন্ন হতে হয়।
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা কারণের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ঘাড় ব্যথার চিকিৎসায় নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়।
দোকানে পাওয়া ওষুধ- ব্যথানাশক ও পেশী শিথিলকারী ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
ট্রাকশন- ট্রাকশন পদ্ধতির মাধ্যমে মেরুদণ্ডের উপরের চাপ কমানো যায়। এতে ঘাড়ের ব্যথা কম অনুভব হবে।
ফিজিওথেরাপি- ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম ঘাড়ের পেশী শক্তিশালী করতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
হিট বা আইস থেরাপি- হিট বা আইস থেরাপি ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
ইনজেকশন- কিছু ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেয়া হতে পারে। এতে দ্রুত সময়ে ব্যথা নিরসন হবে।
সার্জারি- যদি অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ না করে তবে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
মলম ব্যবহার
ঘাড় তীব্র ব্যথা হওয়ার আগে যখন অল্প ব্যথা করে সেসময় মলম ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। তবে মলম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই নজরে রাখতে হবে যেন মলম দেয়ার সময় বেশি চাপ প্রয়োগ করা না হয়।
ভোলিনি- এ স্প্রে বা মলম পেশী ও জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান উপাদান হলো ডাইক্লোফেনাক ডাইথাইলামাইন, যা প্রদাহ ও ব্যথা সৃষ্টিকারী রাসায়নিকের নিঃসরণ রোধ করে। এছাড়া এতে মিথাইল স্যালিসাইলেট ও মেন্থল থাকে যা ব্যথানাশক ও শীতলতা প্রদান করে।
ঘাড় ব্যথা প্রতিরোধের উপায়
ঘাড় ব্যথা প্রতিরোধে নিচের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
সঠিক ভঙ্গি- দীর্ঘসময় একই ভঙ্গিতে বসে থাকা এড়িয়ে চলতে হবে। কম্পিউটারে কাজ করার সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখতে হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা- অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডের উপর চাপ বাড়ায়।
নিয়মিত ব্যায়াম- ঘাড়ের পেশী শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।