ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা যেন একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নানাবিধ দুর্ভোগ নেমে আসে। যানজট, দুর্ঘটনা, রাস্তার ধস—এসবই ঢাকাবাসীর নিয়মিত চিত্র। অথচ গত পাঁচ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে খরচ করেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সেই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও জনগণের জীবনযাপনে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, বরং অভিযোগ উঠেছে পুরো প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে।
ঢাকার নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সমস্যা নতুন নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সম্ভাবনার শহরটি আজ পরিকল্পনাহীনতার ভারে জর্জরিত। সিটি করপোরেশনগুলোর উদ্যোগ সত্ত্বেও ঢাকার পরিচয় একটি বাসযোগ্য নগর হিসেবে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এক সময় রাজধানী ঢাকার চারপাশে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু এবং শীতলক্ষ্যা নদী ছিল দেশের স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের পথ। এছাড়াও ৬৫টি খাল ও জলাশয় শহরের পানি নিষ্কাশনের কাজ করে আসছিল। কিন্তু অব্যাহত দখল, ভরাট এবং অবহেলার কারণে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।
গ্রেট ব্রিটেনের নগর পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসের ১৯১৭ সালের ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’ খাল ভিত্তিক পানি নিষ্কাশনের একটি উজ্জ্বল নকশা ছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, ঢাকার খালগুলোই হবে বৃষ্টির পানি নদীতে পৌঁছানোর মাধ্যম। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হয়নি। খালের দখল, ভরাট এবং অপরিকল্পিত বক্স কালভার্টের কারণে পানি নামার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার থেকে নালা ও খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে জলাবদ্ধতার পুরো দায় এসে পড়ে সিটি করপোরেশনের কাঁধে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় ৫০০ কোটি টাকা এবং উত্তর সিটি করপোরেশন ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে খাল খনন, ড্রেনেজ উন্নয়ন, স্লুইসগেট সংস্কারের মতো প্রকল্পে। কিন্তু এর পরও নতুন নতুন এলাকা জলাবদ্ধতার তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া জানান, “প্রতি বছর ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়, কিন্তু বৃহৎ পরিসরের প্রকল্প নেয়া হয়নি। অতি বৃষ্টিতে যা করা হয়, তা যথেষ্ট নয়।” তিনি আরও জানান, “জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য দুইটি প্রকল্প এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।”
অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান উল্লেখ করেছেন, “প্রধান সমস্যা হলো ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের অভাব এবং খাল সংরক্ষণে ব্যর্থতা। জলাবদ্ধতা নিরসনে সঠিক পরিকল্পনা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন।”
এদিকে, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা দাবি করছেন, সিটি করপোরেশনগুলোর কাজের উন্নতি হচ্ছে। উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানিয়েছেন, “গত ছয় মাসে ৯৬ কিমি খাল খনন করা হয়েছে এবং ২২০ কিমি নালা পরিষ্কার করা হয়েছে।” তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ড্রেনের অভাব, পলিথিনের বাধা এবং চলমান খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই বাস্তবতায়, যখন সিটি করপোরেশন সফলতার দাবি করছে, তখন বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে জনগণের হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিগাতলা থেকে নীলক্ষেত বা শেওড়াপাড়া থেকে পাইকপাড়া—বর্ষার পানিতে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা নগরের অক্ষমতার উজ্জ্বল উদাহরণ। জনগণের অর্থে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু সুফল মানুষের জীবনে পৌঁছায়নি। প্রকল্প, মিটিং, খনন এবং ব্রিফিংয়ের ভীড়ে ঢাকা ডুবে যাচ্ছে, স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠেছে।
অবশেষে বলা যায়, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের জন্য একটি টেকসই এবং সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও এই নগরীর জন্য একটি কার্যকরী সমাধান বের করা না গেলে, ঢাকার জলাবদ্ধতা একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবেই থেকে যাবে।