ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে প্রাণঘাতী সহিংসতার দুদিন পর ‘থ্রি ইডিয়টস’ খ্যাত শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। খবর পিটিআইয়ের।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, তাকে কঠোর জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএ)-এর আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই আইনে দীর্ঘমেয়াদী আটকাদেশের সুযোগ রয়েছে, যাতে অভিযুক্তের জামিনের কোনো সুযোগ থাকে না। সূত্রগুলো জানিয়েছে, তাকে আজ রাতেই বা আগামীকাল সকালে লাদাখ থেকে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে।
একসময় কাশ্মীরের অংশ থাকা লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলন বুধবার (২৪) সেপ্টেম্বর) প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নেয়। এতে চারজন নিহত ও অর্ধশত লোক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে জারি হয় কারফিউ। মোতায়েন করা হয়েছে আধা সামরিক বাহিনীও। সেখানে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক সন্দেহভাজন ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মনে করছে, লাদাখে এখনকার যে পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী ওয়াংচুক। এজন্য তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈদেশিক অনুদান সংক্রান্ত একটি অভিযোগের তদন্তও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই। এমনকি ওয়াংচুকের স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ বা ‘সেকমল’র নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে আর কোনো তহবিল গ্রহণ করতে পারবে না এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান।
যদিও ওয়াংচুকের দাবি, তার ‘সেকমল’ কখনো বিদেশি তহবিল নেয়নি। তবে জাতিসংঘ, সুইজারল্যান্ড এবং ইতালীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করেছে এবং সব ধরনের কর পরিশোধ করেছে।
দীর্ঘদিন সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করলেও ৫৯ বছর বয়সী ওয়াংচুক ২০১৯ সাল থেকে লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় হন। উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতিবাদে একাধিকবার অনশন করে সচেতনতা সৃষ্টি ও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। ধীরে ধীরে প্রচলিত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রভাবকে ছাড়িয়ে সাধারণ লাদাখিদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন সোনম ওয়াংচুক। এমনকি দাবি আদায়ে দিল্লি অভিমুখেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি।
এর ধারাবাহিকতায় লাদাখের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা আদায়ে তার নেতৃত্বে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ জন অনশন শুরু করেন, তাদের মধ্যে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। তারপরই ‘লাদাখ এপেক্স বডি’র যুব সংগঠন হরতালের ডাক দেয়, যেখান থেকে সহিংসতা হয়।
বিবিসির খবর অনুসারে, অনশন চলাকালে একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলন করে সোনম ওয়াংচুক বলেন, ৭২ বছর বয়সী তে্সরিং ওয়াংচুক এবং ৬০ বছর বয়সী তাশি ডোলমার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়েছে, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। এই ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।
ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তিনি উত্তেজনা সৃষ্টি করতে আরব বসন্তের মতো আন্দোলনের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং নেপালের জেন-জির বিক্ষোভের কথাও বলেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ওয়াংচুকের উত্তেজক ভাষণে উত্তেজিত হয়ে অনশনস্থল থেকে বেরিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের দফতর এবং কিছু সরকারি দফতরে হামলা চালানো হয়।
এদিকে সহিংসতার পরে সোনম ওয়াংচুক তার অনশন আন্দোলন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং যুবসমাজের প্রতি ভাঙচুর না করার আবেদন জানান।
তিনি বলেন, যুবসমাজ সহিংসতা বন্ধ করুক, কারণ এতে আমাদেরই আন্দোলনের ক্ষতি হবে, পরিস্থিতির অবনতি হবে।
এই শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী বলেন, লাদাখে গণতন্ত্র নেই এবং সাধারণ মানুষের কাছে এই অঞ্চলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও পূরণ করা হয়নি।
উত্তরপূর্বের ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম আর আসামের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল কার্যকর। এই তফসিল অনুযায়ী প্রশাসন, রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ক্ষমতা, স্থানীয় প্রশাসন পরিচালন ব্যবস্থা, বিকল্প বিচার ব্যবস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে।
চীন লাগোয়া লাদাখ অঞ্চলটি আগে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যেরই অন্তর্গত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা–৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময়েই লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়।