মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯ পূর্বাহ্ন

বিলুপ্তির পথে দেড়শ বছরের বাজপাই জমিদারবাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১৫ বার
প্রকাশ: সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

পিরোজপুর শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ইন্দুরকানী উপজেলার পাড়েরহাট বন্দরে কঁচা নদীর তীরঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দেড় শতাব্দী পুরোনো বাজপাই জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত এ জমিদারবাড়ি স্থানীয়ভাবে ‘লালা বাবুর জমিদারবাড়ি’ নামে বেশি পরিচিত। একসময় এখান থেকেই পরিচালিত হতো এলাকার বিচার-সালিশ, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং খাজনা আদায়। অথচ আজ সংরক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি বিলুপ্তির পথে।

তৎকালীন এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন সূর্য প্রসন্ন বাজপাই, যাকে স্থানীয়রা ‘লালা বাবু’ নামে চিনতেন। তিনি ছিলেন জমিদার কালীপ্রসন্ন পারের পালক ছেলে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সূর্য প্রসন্ন ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপাইয়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাড়েরহাট বন্দরের প্রধান শাসনকেন্দ্র ছিল এ কাচারিবাড়ি।

সরেজমিনে জানা যায়, প্রায় ৩ একর জমির ওপর এ জমিদারবাড়ি নির্মিত। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কয়েকটি ভবন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে কাচারি ঘর, সভাকক্ষ, শয়নকক্ষ, নাগ মন্দির ছিল। এমনকি ওই সময়ের শাসন আমলের দুটি পুকুর এখনো রয়েছে কিন্তু বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে বিশাল পিলার, টালির ছাউনি, লতাপাতায় ঢেকে থাকা দেওয়াল এবং ভেঙে পড়া সভাকক্ষ যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও ছাদ ধসে পড়েছে, কোথাও আবার ইটের গাঁথুনি খসে পড়ছে। বাড়ির ভেতরের নাগ মন্দির ও শয়নকক্ষ আজ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

বিলুপ্তির পথে দেড়শ বছরের বাজপাই জমিদারবাড়ি

জমিদার সূর্য প্রসন্ন বাজপাই তার মায়ের নামে পাশেই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রাজলক্ষ্মী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যা বর্তমানে রাজলক্ষ্মী স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে পরিচিত। বাজপাই পরিবারের আরও একটি ঠিকানা ছিল ভারতের এলাহাবাদে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর বাজপাই পরিবার ভারত চলে যায় এবং আর কখনো ফিরে আসেনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জমিদারবাড়িটির জমি বর্তমানে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত হলেও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে দখলের চেষ্টার ঘটনাও আছে। তাদের দাবি, এটি সংস্কার করে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে নদীবন্দর কেন্দ্রিক সম্ভাবনাময় একটি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান হিসেবে পাড়েরহাট নতুন পরিচিতি পেতে পারে। যেটি থেকে সরকার রাজস্বও পেতে পারে। এজন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দরকার, যা দিয়ে এ জমিদারবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়বে যুগের পর যুগ।

বিলুপ্তির পথে দেড়শ বছরের বাজপাই জমিদারবাড়ি

পাড়েরহাট ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আবুল কালাম ফরাজী বলেন, ‘এখানকার জমিদার ছিলেন কালী প্রসন্ন বাজপাই এবং তার পালক ছেলে সূর্য প্রসন্ন বাজপাই। এখানে বিচার সালিশি করা হতো, জমির খাজনা আদায় করা হতো। বর্তমানে স্থাপনাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। সরকার এটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখানে পাঠশালা ছিল, আমরা লেখাপড়া করতাম। বর্তমানে সম্পত্তি সরকারের তত্ত্বাবধানে আছে। এখানে একটি তহশিল অফিস আছে। একটি কালি মন্দির আছে। পেছনে দুটি পুকুর আছে। লালা বাবু যে বাড়িতে থাকতেন, সেটিও বর্তমানে পরিত্যক্ত। সরকার থেকে যদি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে স্থাপনাটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে।’

স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার সাহা বলেন, ‘বাড়িটি সূর্য প্রসন্ন বাজপাইয়ের। যাকে আমরা লালা বাবু নামে চিনি। তার বাবা ছিলেন কালি প্রসন্ন পার, যার নাম অনুসারে পাড়েরহাটের নামকরণ করা হয়েছে। লালা বাবু অত্যাচারী জমিদার ছিলেন না। এখানে দুর্গা মন্দির, কালি মন্দির সহ ৩টি মন্দির ছিল। যা আমরা মুরুব্বিদের কাছ থেকে শুনেছি। বর্তমানে একটি কালি মন্দির আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান হতো, যাত্রাপালা হতো। দিনে দিনে এগুলো সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি এটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণ করে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলে, তাহলে বাড়ির ঐতিহ্য বৃদ্ধি পাবে। জমিদারের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে। সাথে সাথে এলাকার উন্নতি হবে। দেশ বিভক্তির পরে ভারতের এলাহাবাদে সূর্য প্রসন্ন বাজপাই চলে যান। তখন ভারতে যে বাড়িটি নির্মাণ করেন, তার নাম রাখেন পাড়েরহাট বাড়ি।’

বিলুপ্তির পথে দেড়শ বছরের বাজপাই জমিদারবাড়ি

স্থানীয় হারুন অর রশিদ বলেন, ‘লালা বাবু এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তিনি এখানে থাকতেন, এখানে বসে বিচার সালিশি করতেন, খাজনা আদায় করতেন। তার মায়ের নাম ছিল রাজলক্ষ্মী। মায়ের নামে তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে সেই স্কুলে এখানকার শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। দেশ বিভক্তির আগে এই জমিজমা ফেলে রেখে তিনি ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছেন। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত আছে। সরকার যদি বাড়িটির ওপরে খেয়াল দিতো, তাহলে ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে গড়ে উঠতো। যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো।’

ইন্দুরকানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান-বিন-মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জমিদারবাড়িটিতে কাচারি ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা আছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বাড়িটিতে খাজনা আদায় হতো। বিভিন্ন রকমের বিচার-সালিশি হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে অযত্ন-অবহেলায় এটি প্রায় ভঙ্গুর হয়ে গেছে। আমরা এটি সংরক্ষণ করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছি। আশা করছি অচিরেই আমরা সমাধান পাবো।’


এ জাতীয় আরো খবর...