বাংলাদেশের চা সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের, প্রতিদিন কোটি মানুষ চা পান করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ তথ্য—আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত জনপ্রিয় টি-ব্যাগগুলোতেই লুকিয়ে আছে বিষাক্ত ভারী ধাতু। এই ধাতুগুলো ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করে তৈরি করছে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডও) সম্প্রতি রাজধানীতে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে।
স্থানীয় বাজার থেকে ১৩টি নমুনা (১২টি টি-ব্যাগ ও একটি খোলা চা পাতা) সংগ্রহ করে পরীক্ষায় দেখা যায়, অধিকাংশেই আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত সীমার বহু গুণ বেশি ক্রোমিয়াম, সিসা, পারদ, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে।
একটি নমুনায় ক্রোমিয়ামের মাত্রা ছিল ১,৬৯০ পিপিএম, যেখানে নিরাপদ সীমা মাত্র ৫ পিপিএম।
সিসার উপস্থিতি ৫১ পিপিএম পর্যন্ত, পারদ ১০৮ পিপিএম পর্যন্ত এবং আর্সেনিক ১৪ পিপিএম পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
কিছু টি-ব্যাগে অতিরিক্তভাবে অ্যান্টিমনি, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামও শনাক্ত হয়েছে।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই ধাতুগুলো দীর্ঘ সময় শরীরে গেলে দেখা দিতে পারে—
উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ
স্নায়ুরোগ ও মানসিক সমস্যা
লিভার ও কিডনির জটিলতা
বন্ধ্যত্ব এবং শিশুদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
ত্বকের ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া
জাতীয় জরিপে দেখা যায়—
দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন চা পান করে।
৫৫ শতাংশ প্রতিদিন ২-৩ কাপ, ১৭ শতাংশ ৪ বা তার বেশি কাপ পান করে।
কিন্তু ৯৯ শতাংশ মানুষ জানে না যে টি-ব্যাগে এমন ধাতু থাকতে পারে।
৯০ শতাংশ কখনো লেবেল বা সার্টিফিকেশন দেখে না।
অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন অজান্তেই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন: বিশেষজ্ঞরা একে স্পষ্ট ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।
চা বোর্ড ও বিএসটিআই: তারা জানিয়েছেন, এটি উদ্বেগজনক গবেষণা, ভবিষ্যতে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়ে আরও বড় আকারে পরীক্ষা প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তর: এটিকে প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আখ্যা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও গভীর গবেষণার সুপারিশ করেছে।
খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ: সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আরও গবেষণা চালানোর পরামর্শ দিয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে—
বাগান থেকে বাজার পর্যন্ত পর্যায়ে নিয়মিত চা পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ।
ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু কমানোর জন্য মাটি ও কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন।
চা জাতীয় সব পণ্যে নিরাপত্তা লেবেল ও সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা।
প্লাস্টিক ও পিইটি টি-ব্যাগ নিষিদ্ধ করা এবং নিরাপদ বিকল্প চালু।
ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়াতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা।
বাংলাদেশে প্রতিদিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চা এখন এক ভয়ংকর ঝুঁকির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। টি-ব্যাগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত ধাতু শুধু শরীর নয়, সামগ্রিকভাবে প্রজন্মের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। গবেষকরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই ঝুঁকি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।