বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের ওজনও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। এই দুইয়ের যুগলবন্দি যদি সময়মতো নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তা রূপ নিতে পারে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, জয়েন্টের ব্যথা ও ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে। বয়সের ছাপ চেহারায় পড়া যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বিপাকক্রিয়ার ধীরগতি, হরমোনের পরিবর্তন এবং দৈনন্দিন শারীরিক সক্রিয়তার অভাবের কারণে ওজনও বাড়তে পারে। কিন্তু এই দুই পরিবর্তনকে যদি সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপনের মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে বয়স বাড়লেও শরীর থাকবে সুস্থ ও রোগমুক্ত।
খাদ্যতালিকায় যেসব খাবার রাখা জরুরি:
১. উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হজমশক্তি কিছুটা কমে আসে। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত আঁশ (fiber) গ্রহণ করলে হজম ভালো থাকে, কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না, রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে।
যে খাবারে আঁশ বেশি: ওটস, লাল বা ব্রাউন চাল, আটা, ছোলা, মুগ ডাল, শিম, বরবটি, করলা, শসা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, আপেল, নাশপাতি, পেয়ারা, কমলা ইত্যাদি। প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫-৩০ গ্রাম খাদ্যআঁশ গ্রহণ করা উচিত।
২. প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার (চর্বি ছাড়া)
পেশির ক্ষয় রোধ এবং শক্তি বজায় রাখতে উচ্চমানের প্রোটিন অপরিহার্য। ওজন নিয়ন্ত্রণেও প্রোটিন সহায়ক কারণ এটি ক্ষুধা কমায় এবং বিপাক বাড়ায়। যেমন ডিমের সাদা অংশ, মুরগির বুকের মাংস (চামড়া ছাড়া), মাছ (রুই, কাতলা, টুনা), ডাল, ছোলা, সয়াবিন, টোফু, গ্রিক দই ইত্যাদি। প্রতিদিন একজন সুস্থ মানুষের জন্য প্রতি কেজি দেহের ওজন অনুযায়ী ১ থেকে ১ দশমিক ২ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা জরুরি।
৩. কম ক্যালোরি ও কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের ফলমূল
ফল শরীরে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে, তবে বেশি মিষ্টি ফল ওজন বাড়াতে পারে। তাই বেছে নিন কম ক্যালরিযুক্ত এবং কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) ফল। উপযুক্ত ফল হলো পেয়ারা, জাম, বেদানা, কমলা, আপেল, স্ট্রবেরি, বরই। তবে কলা, আঙুর, কাঁঠাল ও পাকা আম বেশি পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৪. ভালো চর্বি
ওজন কমাতে একদম চর্বি বাদ দেওয়া ঠিক নয়। বরং প্রয়োজন ভালো চর্বি, যা হৃদযন্ত্রকে ভালো রাখে। ভালো চর্বির উৎস হলো–
অলিভ অয়েল, বাদাম (আখরোট, কাঠবাদাম), তিল, চিয়া সিড, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখীর বিচি, সামুদ্রিক মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি।
৫. কম সোডিয়াম ও কম প্রক্রিয়াজাত খাবার:
বয়স বাড়লে রক্তচাপ ও কিডনি সমস্যা দেখা দেয়। তাই প্রক্রিয়াজাত, অতিরিক্ত লবণ দেওয়া খাবার (ফাস্ট ফুড, চিপস, আচার, প্যাকেটজাত স্যুপ) যত কম খাবেন, তত ভালো।
৬. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার:
বয়স বাড়লে হাড় দুর্বল হয়। তাই ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি প্রয়োজন হাড় মজবুত রাখতে। যেমন দুধ, টক দই, কালচে শাক (পালং, লাল শাক), ছোট মাছ, ডিমের কুসুম (সীমিত পরিমাণে)। এছাড়া ভিটামিন ডি এর জন্য অন্তত প্রতিদিন গায়ে ১৫-২০ মিনিট শরীরে রোদ লাগানো।
যেসব অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে
১. নিয়মিত ছোট পরিমাণে খাওয়া:
তিন বেলার খাবারের পাশাপাশি হালকা দুই-তিনটি স্ন্যাকস রাখুন। এতে অতিরিক্ত ক্ষুধা কমে এবং ইনসুলিন রেসপন্সও নিয়ন্ত্রিত থাকে।
২. পানি পান বাড়ান:
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃষ্ণাবোধ কমে আসে। ফলে পানি কম খাওয়া হয় এবং হজমজনিত সমস্যা বাড়ে। দিনে ৮–১০ গ্লাস পানি পান করুন।
৩. চিনি ও মিষ্টান্ন কমান:
বয়স ও ওজন বাড়লে চিনি জাতীয় খাবার শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়াতে পারে। কেক, পেস্ট্রি, সফট ড্রিংক, চিনি দেওয়া চা-কফি কমাতে হবে।
৪. রাতের খাবার হালকা রাখুন:
রাতে হজম ধীরগতির হয়। তাই হালকা ও কম ক্যালরিযুক্ত খাবার রাখুন। ভাজাপোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম করুন:
বয়স যতই হোক না কেন, হালকা হাঁটা, যোগ ব্যায়াম, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা জল-ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও বিপাক বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত পক্ষে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট হাঁটা হাঁটি করা ভালো।
৬. স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন:
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। যেমন রক্তচাপ, সুগার, লিপিড প্রোফাইল, বিভিন্ন রকম হরমোন ইত্যাদি।
৭. মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখুন
ঘুম ঠিক রাখতে হবে, প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা। এছাড়া স্ট্রেস কমানো জরুরি। তাই মেডিটেশন বা ধ্যান অভ্যাস করতে পারেন। ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে নিজেকে সক্রিয় রাখতে পারেন, যা মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বয়স ও ওজন—দুটোই জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন রীতি অনুসরণ করে এই পরিবর্তনকে সুস্থতার পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবার রাখুন, প্রয়োজন হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, বয়স বাড়া মানেই দুর্বল হওয়া নয়—বয়স বাড়লেও আপনি সুস্থ, কর্মক্ষম এবং প্রাণবন্ত থাকতে পারেন।